মুরারিচাঁদ (এম. সি.) কলেজের সংক্ষিপ্ত ইতিহাস
সিলেট শহরস্থ’ রায়নগরের জমিদার বাবু মুরারিচাঁদ রায়ের বিধবা সন্তানহীনা কন্যা ব্রজসুন্দরী দেবীর দত্তক পুত্র রাজা গিরিশ চন্দ্র রায় ১৮৮৬ খ্রিস্টাব্দে সিলেট শহরে মুরারিচাঁদ স্কুল নামে একটি উচ্চচবিদ্যালয় স্থাপন করেন। অচিরেই রাজা স্কুলটিকে কলেজ পর্যায়ে উন্নীত করতে উদ্যোগী হন। ফলে ১৮৯২ খ্রিস্টাব্দে ২৭ শে জুন কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীন এফ. এ. (বর্তমান উচ্চমাধ্যমিক) কোর্স চালুর মাধ্যমে মাত্র ১৮ জন ছাত্র নিয়ে একটি দ্বিতীয় শ্রেণির কলেজরূপে এম. সি. কলেজের শুভ উদ্বোধন ঘটে। তখন একই ভবন এবং একই শিক্ষকমন্ডলী দ্বারা স্কুল ও কলেজ উভয় প্রতিষ্ঠানের শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালিত হত। অবকাঠামোগত ও উপকরণগত দৈন্য এবং অত্যন্ত অল্প শিক্ষক নিয়ে এক পা এক পা করে এগিয়ে চলছিল এম.সি.কলেজ। কিন্তু ১৯০৬ খ্রিস্টাব্দে নতুন University Regulations কার্যকর হলে সমস্যা জর্জরিত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানটির অস্তিত্ব হুমকির সম্মুখীন হয়। তখন কলেজটিকে টিকিয়ে রাখার জন্য রাজা গিরিশচন্দ্র রায় সরকারের শরনাপন্ন হন। ১৯০৮ খ্রিস্টাব্দে সরকারি অনুদান লাভে সক্ষম হওয়া শিক্ষা প্রতিষ্ঠানটি ধ্বংস হয়ে যাবার হাত থেকে রক্ষা পায়। উল্লেখ্য ঐ বছর রাজা গিরিশ চন্দ্র রায় মৃত্যুবরণ করেন। আসামের তদানীন্তন চীফ কমিশনার স্যার আর্চডেল আর্ল ১৯১২ খ্রিস্টাব্দে এম. সি. কলেজকে সরকারের পূর্ণ নিয়ন্ত্রণে গ্রহণ এবং প্রথম শ্রেণীর কলেজে উন্নীত করার ঘোষণা দেন। অতঃপর সিলেট শহরে অবস্থিত ত্রিভুজাকৃতি তদানীন্তন গোবিন্দচরণ পার্ক-এ (বর্তমান হাসান মার্কেট) বাঁশ ও নল-খাগড়া দিয়ে কলেজের জন্য গৃহ নির্মাণ করা হয়। ইন্টারমিডিয়েট স্তরে বিজ্ঞান কোর্স চালু হলে নিকটবর্তী রাজা জি. সি. হাইস্কুলে পানি সরবরাহ ও গ্যাস সিলিন্ডারের ব্যবস্থা করে গবেষণাগার গড়ে তোলা হয়। সরকারের পূর্ণ নিয়ন্ত্রণে অঙ্গীভূত হলেও তখনও এম. সি. কলেজ প্রথম শ্রেণির মর্যাদা পায়নি। এম.সি.কলেজকে প্রথম শ্রেণির কলেজে উন্নীতকরণ এবং ডিগ্রি কোর্স চালু করার দাবীতে স্থানীয় জনসাধারণ আন্দোলন শুরু করেন। এ আন্দোলনের নেতৃত্বে ছিলেন সিলেট শহরস্থ কাজী ইলিয়াছ মহল্লাবাসী এবং কলেজ পরিচালনা পরিষদের অন্যতম সদস্য খাঁন বাহাদুর সৈয়দ আব্দুল মজিদ, সি.আই. ই ওরফে কাপ্তান মিয়া। জনগণের দাবীর প্রেক্ষিতে স্যার আর্চডেল আর্ল প্রস্তাব করেন যে, কলেজ পরিচালনার প্রথম দুই বৎসরের ব্যয়ের অর্ধেক জনসাধারণ বহন করতে সম্মত হলে এম. সি. কলেজে ডিগ্রি কোর্স চালু এবং কলেজটিকে প্রথম শ্রেণির কলেজে উন্নীত করা সরকারের পক্ষে সম্ভব হবে। এমতাবস্থায় কাপ্তান মিয়ার সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত সভায় নয়জন গণ্যমান্য বিদ্যানুরাগী ব্যাক্তিবর্গ প্রয়োজনীয় অর্থ সংস্থানের ব্যবস্থা করতে সম্মতি জ্ঞাপন করেন। তারা হলেন- (১) খান বাহাদুর সৈয়দ আব্দুল মজিদ, সি.আই.ই, (২) রায় বাহাদুর নলিনী কান্ত দস্তিদার, (৩) খান বাহাদুর হাজী মুহম্মদ বখত মজুমদার, (৪) রায় বাহাদুর বৈকুন্ঠনাথ শর্মা, (৫) রায় বাহাদুর সুখময় চৌধুরী, (৬) রায় বাহাদুর প্রমোদ চন্দ্র দত্ত, (৭) বাবু সারদা চরণ শ্যাম, (৮) বাবু রাধা বিনোদ ধাম, (৯) বাবু হরেন্দ্র চন্দ্র সিনহা। উপযুক্ত জনদরদী ব্যক্তিবর্গ কলেজের দুই বৎসরের ব্যয়ের অর্ধেক হিসেবে আঠারো হাজার টাকা সরকারকে প্রদান করেন। এভাবে জনসাধারণের প্রবল দাবী এবং সমাজসেবী কর্তৃক আংশিক অর্থ সংস্থানের ফলে ১৯১৬ খ্রিস্টাব্দের জুলাই থেকে এম. সি. কলেজে ডিগ্রি কোর্স প্রবর্তিত হয় এ এবং কলেজটি প্রথম শ্রেণির কলেজের মর্যাদা লাভ করে। তখনও এম. সি. কলেজ গোবিন্দচরণ পার্কে কাঁচা ঘরে অবস্থান করছিল। ১৯২১ খ্রিস্টাব্দে জানুয়ারি মাসে খান বাহাদুর সৈয়দ আব্দুল মজিদ আসাম সরকারের শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব গ্রহণ করেন এবং এম. সি. কলেজকে একটি আদর্শ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে রূপান্তরিত করতে আত্মনিয়োগ করেন। সিলেট শহর থেকে প্রায় তিন মাইল পূর্বে অবস্থিত থ্যাকারে টিলাটি কলেজের জন্য নির্বাচিত হয়। প্রায় দেড়শত একর খাস জমি কলেজের জন্য হুকুম দখল করা হয়। ১৯২১ খ্রিস্টাব্দের ১৯ শে আগস্ট আসামের গভর্নর স্যার উইলিয়াম মরিস কলেজের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন। নির্মাণ কাজ শুরু হলে শিক্ষা মন্ত্রী কাপ্তান মিয়া শিলং থেকে ছুটে এসে ব্যক্তিগতভাবে তা তদারকি করতেন। সরকারি খাস নাম অর্থাৎ এম. সি. কলেজ বজায় রাখতে সম্মত হন। অত্যন্ত দুঃখজনক বিষয় নতুন স্থানে এম. সি. কলেজের উদ্বোধনের আগেই ১৯২২ খ্রিস্টাব্দের ২৯ শে জুন মাত্র পঞ্চাশ বৎসর বয়সে খান বাহাদুর আব্দুল মজিদ সি.আই.ই মন্ত্রী থাকাকালে শিলং-এ ইন্তেকাল করেন।
কলেজের নির্মাণ কাজ সম্পন্ন হলে ১৯২৫ খ্রিস্টাব্দে ২৭ শে জুলাই আসামের তদানীন্তন গভর্নর এক আড়ম্বরপূর্ণ অনুষ্ঠানে অনিন্দ সুন্দর নতুন ক্যাম্পাসে এম. সি. কলেজের উদ্বোধন করেন। উদ্বোধনী বক্তৃতায় তিনি কাপ্তান মিয়ার অবদান শ্রদ্ধার সহিত স্মরণ করেন- The good and brave khan Bhahadur has gone before seeing the compleion of the new college at Sylhet and the other boons and reforms for which he worked so hard. কিন্তু অত্যন্ত পরিতাপের বিষয় এম.সি.কলেজের কোথাও খান বাহাদুর সৈয়দ আব্দুল মজিদ, সি.আই.ই এর কোন স্মৃতিচিহ্ন নেই, যিনি ছিলেন এম. সি. কলেজের বর্তমান দৃষ্টিনন্দন ক্যাম্পাসের বিশিষ্ট রূপকার।
এম. সি. কলেজ কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীন আই.এস.সি (বর্তমান উচ্চমাধ্যমিক বিজ্ঞান) ১৯১৩ খ্রিস্টাব্দে এবং ডিগ্রি কলা ১৯১৬ খ্রিস্টাব্দে চালু হয়। ১৯১৮ খ্রিস্টাব্দে সংস্কৃতিতে এবং ১৯২২ খ্রিস্টাব্দে ইংরেজি, ফারসি, আরবি, গণিত, দর্শন ও ইতিহাসে অনার্স পর্যায়ে শিক্ষাদান আরম্ভ হয়। ১৯২৬ খ্রিস্টাব্দে ডিগ্রি বিজ্ঞান কোর্স চালু হয় এবং ১৯২৭ খ্রিস্টাব্দে পদার্থ ও রসায়ন শাস্ত্রে অনার্স স্তরে শিক্ষাদান শুরু হয়। বিশ্ববিদ্যালয়ের পরীক্ষাসমূহের গৌরবময় ফলাফলের জন্য এম. সি. কলেজ উপমহাদেশের অন্যতম সুনামধন্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠান হিসেবে পরিচিতি লাভ করে।
পাকিস্তান সৃষ্টির কয়েক বৎসর পর ১৯৫৫ খ্রিস্টাব্দে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীন এম. সি. কলেজ থেকে সাময়িকভাবে অনার্স কোর্স তুলে নেয়া হয়। তবে ১৯৬১ খ্রিস্টাব্দে পুনরায় ইংরেজি, বাংলা, রাষ্ট্রবিজ্ঞান, অর্থনীতি, গণিত, পদার্থবিজ্ঞান, রসায়ন শাস্ত্রে অনার্স কোর্স প্রবর্তিত হয়। ১৯৬৮ খ্রিস্টাব্দে এম. সি. কলেজ নবপ্রতিষ্ঠিত চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে চলে আসে এবং ১৯৭০ খ্রিস্টাব্দে এখানে ইংরেজি, বাংলা, রাষ্ট্রবিজ্ঞান, অর্থনীতি ও গণিতে মাস্টার্স ১ম বর্ষ শিক্ষা কার্যক্রম চালু হয়। কিন্তু স্বাধীনতা উত্তর বাংলাদেশে প্রধানতঃ শিক্ষক স্বল্পতার কারণে সকল বিষয়ে মাস্টার্স ১ম পর্ব কোর্স বিলপ্ত হয়ে যায়। অপরদিকে ১৯৭২ খ্রিস্টাব্দে উদ্ভিদবিদ্যা অনার্স কোর্স প্রবর্তিত হয়। ১৯৯৩ খ্রিস্টাব্দে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হলে সারা দেশের সকল কলেজসমূহের সাথে এম. সি. কলেজও এর অধীনে চলে আসে।
জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীন এম. সি. কলেজে প্রাণিবিদ্যা ও সমাজবিজ্ঞানে অনার্স কোর্স চালু হয়। পরবর্তীতে সংশ্লিষ্ট বিষয়গুলোতে মাস্টার্স কোর্স প্রবর্তিত হয়। বর্তমানে এম. সি. কলেজে বাংলা, ইংরেজি, গণিত, পদার্থবিজ্ঞান, রসায়ন, উদ্ভিদবিদ্যা, প্রাণিবিদ্যা, রাষ্ট্রবিজ্ঞান, অর্থনীতি, দর্শন, সমাজবিজ্ঞান, মনোবিজ্ঞান, ইতিহাস, ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি এবং পরিসংখ্যান বিষয়ে অনার্স ও মাস্টার্স কোর্স চালু রয়েছে। এছাড়া ইসলামী শিক্ষা বিষয়ে মাস্টার্স কোর্স চালু রয়েছে।
উল্লেখ্য যে, ১৯৬৪ খ্রিস্টাব্দে তদানীন্তন পাকিস্তান শিক্ষা বিভাগের পরিকল্পনায় দেশের প্রধান কলেজগুলো থেকে উচ্চমাধ্যমিক স্তর পৃথকীকরণ প্রক্রিয়ায় এম. সি. কলেজ থেকে উচ্চমাধ্যমিক মানবিক ও বাণিজ্য শ্রেণিগুলোর বিলুপ্তি ঘটে; তবে বিশেষ বিবেচনায় এম. সি. কলেজে উচ্চমাধ্যমিক বিজ্ঞান বহাল থাকে। তখন এম. সি. কলেজের নতুন নামকরণ হয় ‘সিলেট সরকারি কলেজ’ এবং অদূরে নব্য প্রতিষ্ঠিত উচ্চমাধ্যমিক কলেজটির নামকরণ হয় ‘এম. সি. ইন্টারমিডিয়েট কলেজ’। নাম পরিবর্তনের যুক্তি ছিল ১৯১২ খ্রিস্টাব্দে এম.সি.কলেজ যখন সরকারি নিয়ন্ত্রণে আসে তখন তা ছিল ইন্টারমিডিয়েট স্তরের। পরবর্তীতে ১৯৮৯ খ্রিস্টাব্দে সিলেটের কৃতিসন্তান জনাব হেদায়েত আহমদ চৌধুরী শিক্ষা সচিব থাকাকালে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের এক ঘোষণায় ‘সিলেট সরকারি কলেজ’ নামের পরিবর্তে পুনরায় ‘মুরারিচাঁদ কলেজ’ নামে নামকরণ হয় এবং অপর কলেজটির নাম ‘সিলেট সরকারি কলেজ’। প্রতিষ্ঠাকাল থেকে মুরারিচাঁদ কলেজ অগাধ পাণ্ডিত্যপূর্ণ ও অসীম ব্যক্তিত্ববান অধ্যক্ষ ও শিক্ষকমন্ডলী কর্তৃক পরিচালিত হয়ে আসছে।